মাটিচাপা

এক শুক্রবারে আল্লাহ আদম (আ) কে নবী বানিয়ে দুনিয়াতে পাঠিয়ে দিলেন।[1] সাথে পাঠালেন হাওয়া (আ) কেও। নবীদের কাছে ফেরেশতারা আকাশ থেকে ‘আল্লাহর কথা’ নিয়ে আসেন। আল্লাহর পাঠানো আদেশ-নিষেধ, উপদেশমূলক এই কথাগুলো বলে ‘অহী’। দুনিয়াতে আদম আর হাওয়া (আ) কিভাবে চলবেন, কি খাবেন, বুদ্ধি দরকার। আল্লাহ তখন তাঁদের কাছে অহী পাঠালেন। শিক্ষা দিলেন কিভাবে জমি চাষ করতে হয়, কিভাবে কৃষিকাজ করতে হয়। আল্লাহর দেওয়া বুদ্ধি দিয়ে আদম (আ) বানালেন চাকা। তখনতো আর মোটরগাড়ি ছিল না। গাধা-গরুর সাথে চাকা লাগানো ভ্যান জুড়ে দিয়ে তাঁরা বানালেন গাড়ি। এই গাড়ি দিয়ে তাঁরা দুনিয়ার জমিনে চলাচল করতেন।[2] এমনি আরো অনেক বুদ্ধি আল্লাহ আদম (আ) কে শিখিয়ে দিলেন।

তাঁদের অনেক সন্তান হলো। আরো পরে হলো অনেক নাতি-নাতনী। এভাবে দুনিয়াটা মানুষে ভরে যাচ্ছিল। এদের কেউ ভালো, কেউ মন্দ। কেউ আল্লাহর কথা শুনে, কেউ ধরে শতানের পথ। তবু, আল্লাহর পাঠানো অহী দিয়ে আদম (আ) তাদের উপদেশ দিতেই থাকতেন।

হাবীল আর কাবীল দুই ভাই। আদম আর হাওয়া (আ) এর সন্তানদেরই দুইজন। দুই ভাইয়ের মাঝে একবার ঝগড়া লাগল।

“কে সঠিক? আমি? না, তুমি? চল, আল্লাহর থেকেই জেনে নেই আমাদের মাঝে কার কথা ঠিক। আমরা দুইজন আল্লাহর জন্য কিছু কুরবানী করব। আল্লাহ যার কুরবানী কবুল করবেন, বুঝব সে-ই ঠিক।”

হাবীল ভেড়া, দুম্বা ইত্যাদি পশু পালে। ভাবছে, এর থেকেই কিছু কুরবানী করা যায়। “আমার এত প্রিয় পশুগুলোর মাঝে খুব সুন্দর একটাকে আল্লাহর জন্য দেওয়া চাই। আল্লাহ ধনী। উনাকে তো আর যেই সেই জিনিস দেওয়া যায় না। আর উনি চাইলে পরে আমাকে আরো দিতে পারেন” সে একটি মোটা-তাজা দুম্বা কুরবানী করল।

কাবীল কৃষিকাজ করত। তার চিন্তা অল্পে অল্পে কিভাবে সারা যায়। “আল্লাহ তো ধনী। তাঁর তো আর এসব কিছুর দরকার নাই। ভালোগুলো আমার-ই থাক। পরে খাওয়া যাবে। যেগুলো নষ্ট হয়ে যেত ঐগুলা কুরবানী করে ফেলি। তাইলে আর আমার ক্ষতি হবে না।” নগণ্য কিছু শস্য কাবীল কুরবানীর জন্যে পেশ করে।

কার কুরবানী কবুল হলো তা বোঝাতে তখন অহী আসত না। আসত আগুন। যার টা কবুল হত তার কুরবানী আকাশ থেকে আগুন এসে পুড়িয়ে দিত। হাবীল, কাবীল দুইজনই অপেক্ষায়, কার কুরবানী আগুনে পুড়ে!

আগুন আসল, পুড়িয়ে দিল হাবীলের মৃত পশুটিকে। আর কাবীলের শস্য পড়েই রইল। আগুন কাছেও আসল না। হাবীল-ই ঠিক পথে আছে তাহলে। আল্লাহ ন্যায় বিচারক। আকাশ থেকে ফয়সালা করে দিলেন।

সহ্য হয় না কাবীলের। আল্লাহর পাঠানো বিচার। মেনে নেওয়া উচিত ছিল তার। মেনে তো নিল-ই না, হিংসা চড়ে বসল কাবীলের। হাবীলের প্রতি হিংসা। “ওরে হাবিল, আমার কুরবানী কবুল হলো না, আর তোর টা কবুল হয়ে গেলো!”

“ভাই কাবীল, বুঝতে চেষ্টা কর।” আল্লাহর সব কুরবানী দরকার নাই। এই গরু, ছাগল, দুম্বা বা শস্য কিছুই আল্লাহর দরকার নাই। আল্লাহ শুধু দেখেন কে তাঁকে ভয় পায়, কে তাঁকে ভালোবাসে। তাঁর রাস্তায় ভালো কিছু কুরবানী করতে কে ভালোবাসে। “আর তাই, আল্লাহ সব কুরবানী কবুলও করেন না।” আর একবার কুরবানী কবুল না হলেও ভয়তো নেই। আল্লাহ তো ক্ষমাশীল, দয়াময়। অন্য কাজগুলো ভালোভাবে করলে তা হয়ত তিনি কবুল করবেন।

কাবীল বুঝতে চায় না। এতো কথা শুনতেও চায় না। হিংসার আগুনে অন্ধ সে এখন। “আমি তোকে মেরেই ফেলব।” হাবীল কে হুমকি দেয় কাবীল।

হাবীল এক চমৎকার মানুষ। ভাইয়ের সাথে মারামারিতে যেতে নারাজ। “ভাইজান, তুমি আমাকে মারলে মার, আমি তোমার গায়ে হাতও তুলব না।” এক মুসলিম কখনো অন্য মুসলিমের গায়ে হাত তুলতে পারে না, জানা ছিল হাবীলের। আর ভাইয়ের হাতে মারা পড়লেও ক্ষতি নেই। মৃতের সব পাপ আল্লাহ মুছে দেন। দিয়ে দেন যে মারল তার ঘাড়ে। কাবীলের এইসব পাপ-টাপ নিয়ে ভাবার সময় নেই তখন। মেরেই ফেলল আপন ভাইকে!

তখন পর্যন্ত মানুষে মানুষে হত্যা ঘটেনি। কাবীল-ই প্রথম। দুনিয়ার প্রথম মানুষ হত্যাকারী। আর তাই আজ পর্যন্ত যত খুন হচ্ছে সব পাপ একটি করে কাবীলের ঘাড়ে জমা হচ্ছে।

কাবীলের ঘাড়ে এতক্ষন শয়তান বসে ছিল। হিংসা ঢুকিয়ে দেয় ভাইয়ে ভাইয়ে। রাগের মাথায় খুনও করিয়ে ফেলে। শয়তান চলে যাওয়ার পর কাবীলের হুস ফিরল, “এ আমি কি করলাম! মেরে ফেললাম নিজের ভাইকে! আচ্ছা, আমি এখন হাবীলের মৃত লাশ কি করি? কোথায় ঢেকে রাখি?” উপায় খোজে পায় না কাবীল।

আল্লাহ চাইলেন মানুষকে কবর দেওয়া শিখাবেন। পাঠালেন দুইটা কাক। কাবীলের সামনেই তারা মারামারি করতে লাগল। এক সময় একটা আরেকটা কে মেরেই ফেলল। এর পর জ্যান্ত কাক টা মাটি খোঁড়া শুরু করল। হয়ে গেলো সুন্দর এক গর্ত। গর্তের মাঝে মৃত কাক টা কে ফেলে মাটি চাপা দিয়ে দিল। কাবীলও শিখে গেলো কিভাবে কবর দিতে হয়। আর এই থেকেই আমাদের মাঝে কবর দেওয়ার প্রচলন চলে আসছে।[3]

………………………………………………………………………………………………………………

[1] সহীস মুসলিম (ইফা): ১৮৪৯; সূরা ত্বহা ২০: ১২২

[2] তাসফীর মা‘আরেফুল কুরআন পৃ-৬২৯।

[3] সূরা আল-মাইদাহ ৫: ২৭-৩১ ও তৎসংশ্লিষ্ট তাফসীর (ইবনে কাসীর থেকে)