দুনিয়াতে অবতরণ

আপাতত আদম (আ) এর থাকার জায়গা হলো জান্নাতে। একাকী-ই সেখানে ঘুরে বেড়ান। টলটলে পানির ঝর্ণা, নদী, ফল-ফুলের বাগান কি নাই সেখানে! শুধু একটি জিনিস ছাড়া। কি সেটা?

সাথী। তখন আদম (আ) কে ছাড়া আর কোন মানুষ যে সৃষ্টি হয় নি। তাই তাঁর একটু একা একা লাগছিল। এক সময় ঘুমিয়ে পড়লেন। ঘুম থেকে উঠেই দেখতে পান মাথার কাছে একজন মেয়ে বসে আছেন।

“তুমি কে হে?” জিজ্ঞেস করলেন আদম (আ)।

“আমি একজন মেয়ে।”

“তোমাকে কেনো সৃষ্টি করা হয়েছে?”

“যাতে আপনি আমার কাছে শান্তি পান।”

এত বড় জান্নাত। অথচ, মানুষ ছিলেন একজন-ই, আদম (আ)। এবার তাঁর-ই শরীরের অংশ থেকে বানানো হলো তার সাথীকে। সেই সাথীর কাছ থেকে শান্তি তো পাবেন-ই। হ্যা, আদম (আ) যখন ঘুমিয়ে ছিলেন তখন তাঁর পাঁজরের হাড় থেকে আল্লাহ এই নারীকে সৃষ্টি করেন। ফেরেশতারা আদম (আ) এর জ্ঞান যাচাই করার জন্য তাঁকে প্রশ্ন করেন, “হে আদম, উনার নাম কি বলুন তো?”

সকল কিছুর নাম-ই তো আদম (আ) কে আগে থেকে শিখানো হয়েছিল। জবাব দিলেন, “তাঁর নাম হাওয়া”।

“আচ্ছা উনার নাম হাওয়া হলো কেনো?” ফেরেশতারা জানতে চাইলেন।

আদম (আ) বললেন, “তাঁকে যে ‘হাই’ অর্থাৎ জীবন্ত কিছু থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে।”[1]

আদম (আ) আর হাওয়া (আ) এর বিয়ে হলো। আল্লাহ আদম (আ) কে বলে দিলেন, “হে আদম, তুমি এবং তোমার সাথী জান্নাতে বসবাস করতে থাক। এখানে যা চাও, যেখান থেকে চাও ইচ্ছে মত খেতে থাক। তবে ঐ যে একটা গাছ দেখা যাচ্ছে, এর কাছেও যাবে না। এর ফল তো খাবেই না। আর না হলে কিন্তু মহাপাপ হয়ে যাবে।[2] আর খেয়াল রাখবে, ইবলিস কিন্তু তোমাদের শত্রু। সে তোমাদের ক্ষতি করতে চায়। ও চায় না তোমরা জান্নাতে থাক। তাই সাবধান থাকবে, ও যেনো তোমাদের জান্নাত থেকে বের না করে দেয়। এখানের বাহিরে কিন্তু এতো শান্তি নেই। তোমরা বাহিরে গেলে কষ্ট পাবে। এখানে থাকলে পেটের খিদায় কষ্ট পাবে না। পিপাসার কষ্টও হবে না। রোদেও কষ্ট পাবে না। আর ভালো জামা-কাপড় তো আছেই।[3]

মানুষ ছাড়া আর কোন প্রাণী জামা-কাপড় পরে না। আল্লাহ মানুষের মাঝে লজ্জা দিয়েছেন। আমাদের শরীর ঢেকে আমাদের সম্মান বাড়িয়ে দিয়েছেন। মানুষকে এতো সম্মান দেওয়া হয়েছে, জান্নাতে রাখা হয়েছে। এটা দেখে ইবলিস শয়তানের হিংসা হলো। সে চাইল মানুষকে অপমান করতে, লজ্জা দিতে, আল্লাহর অবাধ্য করতে। আর তাই ফন্দি আঁটতে লাগল, কি করা যায়। কিভাবে আদম আর হাওয়ার (আ) ক্ষতি করা যায়? একসময় পেয়ে গেলো বুদ্ধি।

সে আদম (আ) আর হাওয়া (আ) এর কাছে এসে বলল, “তোমরা তো জান্নাতে বেশ আছ। কিন্তু আর কয়দিন-ই বা বাঁচাবে? কয়দিন-ই বা এখানে থাকতে পারবে?”

বটেই তো। এতো সুন্দর জায়গা, চিরকাল থাকতে পারলেই না মজা টা হয়!

ইবলিস আবার পরামর্শ দেয়, “আমি কি তোমাদের বলে দিব এমন গাছের কথা যার ফল খেলে তোমরা চিরকাল বাঁচবে? তোমাদের এই জান্নাতের রাজত্ব থেকে আর বেরও হতে হবে না।”

প্রস্তাবটা লোভনীয়। তবে, ও কি সত্য বলছে?!

আরো কোমল হয় ইবলিস। মিষ্টি করে বলে, “আল্লাহর কসম, আমি তোমাদের ভালো চাই। তোমাদের আগে এখানে আমি থাকতাম। আমি এই জান্নাতের সবকিছু ভালোভাবে চিনি।”

তাহলে আল্লাহ যে এর কাছে যেতেও নিষেধ করলেন!

সবচেয়ে বড় মিথ্যাটা ইবলিশ শয়তান এবার বলল, “তোমাদের রব এই গাছের কাছে যেতে নিষেধ করেছেন একটা কারণে। এর ফল খেলে যে তোমরা ফেরেশতা হয়ে যাবে! জান্নাতের চিরস্থায়ী বাসিন্দা হয়ে যাবে! এটা তো তিনি চান না।”

ইবলিস এভাবে প্রতারণা করে আদম (আ) আর হাওয়া (আ) কে রাজি করিয়ে ফেলল। নিষিদ্ধ গাছের ফল খেয়ে ফেললেন তারা। ভুলে গেলেন আল্লাহর নিষেধ, ভুলে গেলেন ইবলিস যে তাঁদের ক্ষতি চায়, ভুলে গেলেন গাছটার কাছে যেতেও যে আল্লাহ নিষেধ করেছিলেন, ভুলে গেলেন বান্দার ভালো আল্লাহর চেয়ে বেশি কেউ চাইতে পারে না। গাছটার ফল এমন যে খাওয়ার সাথে সাথে তাদের গায়ের কাপড় খুলে গেলো। তারা খুব লজ্জা পেলেন। লজ্জায় গা ঢাকা শুরু করলেন গাছের পাতা ছিড়ে। আর এটাই শয়তান চাচ্ছিল যে মানুষ লজ্জিত  হোক, আল্লাহর অবাধ্য হোক।

ঘটনায় আল্লাহ অত্যন্ত অখুশি হলেন তাঁদের উপর। বললেন, “হে আদম আর হাওয়া, আমি কি তোমাদেরকে এ গাছটির কাছেও যেতে নিষেধ করি নাই? আমি কি বলি নাই যে, শয়তান তোমাদের মহাশত্রু?”

আদম (আ) শয়তানের মত যুক্তি দিলেন না। অকপটে স্বীকার করলেন, “হে আমাদের পালনকর্তা আমরা নিজেদের প্রতি অন্যায় করেছি। যদি আপনি আমাদেরকে ক্ষমা না করেন, আমাদের প্রতি দয়া না করেন, তবে আমরা অবশ্যই শেষ হয়ে যাব। আর আমাদের এটা ধারণাও ছিল না যে, আপনার নামে কসম খেয়ে কেউ মিথ্যা বলতে পারে।”

ক্ষমশীল আল্লাহ আদম (আ) আর হাওয়া (আ) কে ক্ষমা করে দিলেন। যত বড় পাপ-ই হোক, ক্ষমা চাইলে তিনি আর রাগ করে থাকতে পারেন না। তবে তিনি চাইলেন এবার মানুষ দুনিয়াতে ফিরে যাক। আদম (আ) ও হাওয়া (আ) কে বলে দিলেন, “দুনিয়াতে তোমরা কিছু দিনের জন্য থাক। ওখানে তোমাদের থাকার সব রকম ব্যবস্থা করা আছে। কিছুদিন  থাকার পর আবার আমার কাছে সকল মানুষকেই নিয়ে আসব। ওখানে যে আমার কথা অনুযায়ী চলবে তার কোন ভয় নাই, চিন্তাও নেই। তাকে আমি আমার জান্নাতেই নিয়ে আসব। আর দুনিয়ায় যে আমার অবাধ্য হবে তাকে পাঠাবো জাহান্নামে। তবে সাবধান করে রাখছি, শয়তান তোমাদের মূল শত্রু। ও তোমাদের জাহান্নামেই নিয়ে যেতে চাইবে।”

নেমে যাবেন আদম আর হাওয়া (আ) দুনিয়াতে। আর এভাবে শুরু হবে মানব জাতির পৃথিবীতে বসবাস।[4]

………………………………………………………………………………………………………………

 

[1] আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া ১ম ক্ষন্ড, পৃ-১৮৬।

[2] সূরা আল-বাকারাহ ২: ৩৫; সূরা আল-আ’রাফ ৭: ১৯

[3] সূরা ত্বহা ২০: ১১৭ – ১১৯

[4] সূরা আল-বাকারাহ ২: ৩৫-৩৯; সূরা আল-আ’রাফ ৭: ১৯-২৫ ও সূরা ত্বহা ২০: ১১৭ – ১২৩ এবং তাফসীর ইবনে কাসীর থেকে সংশ্লিষ্ট আয়াতের তাফসীর।


Next